বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৬ অপরাহ্ন

সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের টাকার পাহাড়

সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের টাকার পাহাড়

আফরিন সুলতানা জুঁই : আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন শরীফ আহমেদ।এর আগে ফুলপুর-তারাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তখন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক না হলেও সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হয়েই কপাল খুলে যায়। এলাকার উন্নয়নের নামে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছে।এই সংসদ সদস্য মদ পান করতেন নিয়মিত। মদ্যপ অবস্থায় তার মারধরের শিকার হয়েছেন বাসার কেয়ারটেকারসহ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে সমাজকল্যাণ ও পরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সবকিছুতে আরও শক্তভাবে থাবা দেন তিনি।

১০ বছরে নিজের এলাকার তেমন উন্নয়ন না করলেও নিজের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন করেছেন। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বাণিজ্য, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন-বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। তার বাবা ভাষাসংগ্রামী প্রয়াত শামছুল হক এই আসনে একবার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং পাঁচবার আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার সময়ও তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু শরীফ আহমেদ প্রতিমন্ত্রী হয়ে ময়মনসিংহ, ঢাকা ও গাজীপুরে বিপুল জমিসহ বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে দ্রুত সম্পদ বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দেখা যায়, ১০ বছরে প্রতিমন্ত্রীর আয় বেড়েছে ৫৪ গুণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আ.লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন শরীফ আহমেদ। তখন তার একমাত্র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটাররা বিবেচনায় আনেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহ শহীদ সারোয়ারকে। বিএনপির কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়ে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ ছিলেন। তবে নীরব ভোট পাওয়ার গুঞ্জন ছিল তার পক্ষে। কিন্তু এই নির্বাচনে ফুলপুর-তারাকান্দা আসন থেকে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৪৩১ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হন শরীফ। তখন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহ শহীদ সারোয়ার পান ১২ হাজার ১৫ ভোট। এই নির্বাচনকেও রাতের ভোট হিসেবে আখ্যা দেন নির্দলীয় ভোটারসহ পরাজিত প্রার্থী।কয়েকবার এমপি হওয়ার সুবাদে শরীফ আহমেদের ডান-বাম হাত হিসেবে পরিচিত নেতারাও অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন। তার প্রতিনিধি হিসেবে এলাকায় বেশ পরিচিত সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান হাবিব।

তিনি ফুলপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি শরীফ আহমেদের হয়ে এলাকার সব কাজ দেখভাল করতেন। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন হাবিব। ২০১৯ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। তবে গত ৮ মে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আলোচনা রয়েছে, শরীফ আহমেদ নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে হাবিবকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এই নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হাবিবের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ বছরে তার ও স্ত্রী লায়লা আক্তার সুমির সম্পদ বেড়েছে দ্রুত গতিতে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় পেশা থেকে বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা, গাড়ি কিছুই ছিল না। স্ত্রীর নামে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ১০ তোলা স্বর্ণ ছিল। স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নিজের কোনো কৃষিজমি না থাকলেও স্ত্রীর নামে ৫০ শতক কৃষিজমি ছিল হেবামূলে। কিন্তু এ বছরের হলফনামায় দেখা যায়, কৃষি খাতে বার্ষিক আয় ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা, স্ত্রীর কৃষি খাতে আয় করেন ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ৪ লাখ ২৩ হাজার ও ব্যবসা থেকে আয় ১১ লাখ টাকা। ১০ বছরের ব্যবধানে তার স্ত্রীও ব্যবসায়ী হয়েছেন। স্ত্রীর ব্যবসা থেকে আয় ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়, নিজের নগদ ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে নগদ ১১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, ২০ লাখ টাকার একটি মাইক্রোবাসও আছে নিজের নামে। ১০ বছর আগে কোনো কৃষিজমি না থাকলেও এবার নিজের নামে ৫ একর সাড়ে ৯৮ শতক জমি রয়েছে। যার মূল্য দেখানো হয় ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

৩ দশমিক ৭৫ শতক অকৃষি জমি ১৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুরে ৫ শতক জমির মূল্য দেখানো হয় ৬ লাখ টাকা, নগরীর কল্পা এলাকায় ৩ শতক জমি ৬ লাখ ৭৫ হাজার, আকুয়া (সানকিপাড়া) এলাকায় ২ দশমিক ৩৮ শতক জমি ৩৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং ফুলপুরের সঞ্চুর মৌজায় ২৩৪ দশমিক ৭৫ শতক জমির মূল্য দেখানো হয় ১১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। অথচ ১০ বছর আগে স্ত্রীর কোনো অ-কৃষিজমি ছিল না। এবার নিজের নামে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয় ১৬ লাখ ৫০ হাজার, ১১৭০ বর্গফুট জায়গার দাম দেখানো হয় ২৭ লাখ ৩৭ হাজার এবং পাঁচতলা দালানের মূল্য ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শরীফ আহমেদের আরেক বিশ্বস্ত ব্যক্তির নাম বাবুল মিয়া সরকার। সম্পর্কে তিনি শরীফের চাচা। প্রধান শিক্ষক হিসেবে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। ২০১৯ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন।

হন তারাকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সাদামাটা বাবুল হয়ে ওঠেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তারাকান্দা বাজারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ডুপ্লেক্স বাড়ি, ময়মনসিংহ নগরীতে বহুতল বাড়ি, ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট, ফিশারিজ এবং শত একর কৃষিজমির মালিক হয়েছেন তিনি। একসময় ছেঁড়া জুতা-জামা পরে সাদামাটা জীবনযাপন করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান বাবুল।

এদিকে শরীফ আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২৫ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তার বক্তব্য জানা প্রয়োজন উল্লেখ করে গত ২৭ অক্টোবর শরীফ আহমেদের ময়মনসিংহের ঠিকানায় চিঠি দিয়ে ৩০ অক্টোবর দুপুর ১২টায় দুদকে উপস্থিত হতে বলেন কমিশনের উপপরিচালক মোহা. নূরুল হুদা। এ ছাড়াও তার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে উপপরিচালক মোহা. নূরুল হুদাকে দলনেতা করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে দুদক। এলাকায় আলোচনা রয়েছে ৫ আগস্টের পর জেলার হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন শরীফ আহমেদ। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অন্য নেতাদেরও। সবাই মোবাইল ফোন বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ময়মনসিংহ পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,যে-কেউ অবৈধ উপায়ে অর্থবিত্তের মালিক হলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে প্রমাণ মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে দুদক।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |